পাখি বিষয়ক যেকোনো মতামত জানাতে আমাদের ইমেইল করুন এই ঠিকানায়ঃ-pakhibuzz@gmail.com

লালমাথা কুচকুচি

লালমাথা কুচকুচিঃ লালমাথা কুচকুচির বৈজ্ঞানিক নাম হল Harpactes erythrocephalus। যার অর্থ রাঙ্গামাথার ফলচোর(গ্রিকঃ harpactes= ফলচোর,eruthro = লাল,kephalos = মাথা। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের আবাস, প্রায় ২৫ লাখ ২০ হাজার বর্গ কিলমিটার।আবাসস্থল এত বিশাল হলেও পুরো এলাকাটির মাত্র অল্পসংখ্যক হ্রাস পেয়েছে।তবে এদের মোট সংখ্যা এখনও আশংকাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছায়নি।সেকারনে আই.ইউ.সি.এন. এই প্রজাতিটিকে Least concern বা ন্যুনতম বিপদ্গ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে।লালমাথা কুচকুচি বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি।বাংলাদেশের বন্যপ্রানী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।


সমগ্র পৃথিবীতে আনুমানিক ১০ হাজারেরও কম পূর্ণবয়স্ক লালমাথা কুচকুচি রয়েছে।
লালমাথা কুচকুচি পুরুষ

বিস্তৃতিঃ
বাংলাদেশ,ভারত,ভুটান,নেপাল,মায়ানমার,মালয়েশিয়া,লাওস,কম্বডিয়া,থাইল্যান্ড,ভিয়েতনাম,ইন্দোনেশিয়া, ও চীনের গহীন চিরসবুজ বনাঞ্চলে লালমাথা কুচকুচির আবাস।এর বঙ্গীয় উপভাসিক নাম কুচকুচিয়া বা কুচকুইচ্যা থেকে ধারনা করা হয় যে বাংলাদেশে এক্সময় এরা সুলভ ও বেশ সুপরিচিত ছিল।তার কারন হচ্ছে,যে পাখি সচরাচর জনসাধারনের চোখে পড়েনা,সেই পাখির সাধারণত কোন বাংলা নাম পাওয়া যায়না।ধারনা করা হয় যে কাঠুরিয়ারা এককালে প্রায়ই পাখিটি দেখতে পেতেন।কিন্তু বাংলাদেশের বনভূমির ব্যাপক ধ্বংসের ফলে পাখিটি বর্তমানে দুর্লভ ও বিপন্ন বলে বিবেচিত। সেদেশে কেবল লাউয়াছড়া ও কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে পাখিটি কদাচিৎ দেখা যায়।

বিবরণঃ
পাখিদের জগতে কেবল ছোট ছোট পাখিরাই রঙচঙে ও উজ্জ্বলতার দিক থেকে প্রথমলালমাথা কুচকুচি সেদিক থেকে ব্যতিক্রম।এর আকার প্রায় পাতিকাকের সমান হলেও উজ্জ্বলতার দিক থেকে এটি অন্যসব রঙিন ছোট পাখিদেরও হার মানায়।এদের দৈর্ঘ্য ৩৫ সেন্টিমিটার,ডানা ১৪.৫ সেন্টিমিটার,ঠোট ২.২সেন্টিমিটার ,পা ১.৯ সেন্টিমিটার,লেজ ১৯.২ সেন্টিমিটার,এবং অজন ৭৫ গ্রাম।পুরুষ কুচকুচির চেহারা স্ত্রী কুচকুচির থেকে কিছুটা আলাদা।পুরুষ কুচকুচির মাথা,ঘাড়,গলা ও বুক সিঁদুরের মতো লাল।পেটের দিকের বাকি অংশ উজ্জ্বল গোলাপি। বুকের লাল ও গোলাপির মাঝখানে একটি সাদা অর্ধবলয় থাকে।লেজ ক্রমানয়ে ছোট থেকে বড় পাল্কে গড়া, অর্থাৎ থরে থরে সাজানো। পিঠ থেকে লেজ হাল্কা দারুচিনি বা মরচে-বাদামি রঙ্গের।ডানার ঢাকনি – পালক খুবই মিহি সাদা ও ধূসর রেখা খচিত ডানা মূলত কাল এবং পালকের মাঝবরাবর কিছুটা অংশ সাদাটে।লম্বা লেজের কিনারা কালো ও ডগা কালো বলয়যুক্ত।কিন্তু বাইরের দিকের প্রতিটি পালকের ডগা সাদা যার ফলে লেজের কিনারা ঢেউখেলানো মনে হয়। চোখের তারা সিঁদুরে- লাল,এর চারপাশের চামড়া নীলাভ-বেগুনি। চোখের গোলকের ত্বক বেগুনি-নীল। ঠোটের কোনা, পা ও পায়ের পাতা বেগুনি।ঠোটের উপরের পাটি বেগুনি-লাল,ও নিচের পাটি কালো বর্ণের। স্ত্রী কুচকুচির সারা শরীর দারুচিনি রঙের। আর এমনিতে শরীরের অন্যান্য অংশের গঠন ও রঙ একরকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির বুক,বগল ও তলপেট পীতাভ সাদা।
স্বভাবঃ
লালমাথা কুচকুচি শান্ত ও লাজুক পাখি।ঘন প্রশস্ত পাতার চিরসবুজ বোন ও মিশ্র বাশবনে বিচরন করে।মানুষের হাঁতে পরিবর্তিত হয়নি এমন পাহাড়ি বনভুমিতেই এস্রা বাস করে; তবে দুই হাজার মিটারের বেশি উঁচু পর্বতে থাকেনা এরা। খুব বেশি স্থানিক এবং একই এলাকায় বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়।সাধারনত একা বা জোড়ায় থাকতে দেখা যায়।বনের ৪-৬ মিটার উঁচু আলয়াধারি ভরা ডালে নীরবে অনেক্ষন ধরে বসে থাকে।বনের ঘন ছাউনির নিচে উড়ে উড়ে এরা উড়ন্ত প্রজাপতি ও মথ শিকার করে এবং দ্বিপদ নাম “ফলচোর”।গাছের আবডালে বসে এরা নম্র মধুর সুরে কিউকিউ….ডাকে।মাঝে মধ্যে জ্ঞান গায়ঃ টিয়াউপ.....টিয়াউপ... ! গলা সুরেলা হলেও এরা আসলে গায়ক পাখি নয়। এর কারন লালমাথা কুচকুচির পক্ষীবিজ্ঞানের ভাষায় কাক আসলে গায়ক পাখি,কারণ এর ভয়েস বক্স রয়েছে।
লালমাথা কুচকুচি স্ত্রী

প্রজননঃ
এপ্রিল থেকে জুলাই এদের প্রজনঙ্কাল।এ সময় ঘন বনে বৃক্ষের প্রাকৃতিক কোটরে কিংবা কাঠঠোকরার শূন্য গর্তে বাসা করে। বাসায় ৩-৪ টি ডিম পাড়ে।ডিমগুলো পীতাভ এবং ডিমের মাপ ২.৮ * ২.৪ সেন্টিমিটার। কত দিনে ডিম ফোটে ,কত দিনে ছানারা বাসা ছাড়ে, কী হারে ছানা মারা যায় ইত্যাদি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায়নি। উন্নয়নশীল ১০-১২টি দেশের মধ্যেই পাখিটির বিস্তৃতি সীমিত বলে এ বিষয়ে গবেষণার কাজ এখনো পর্যাপ্ত নয়।
তথ্যসূত্রঃ
১.বাংলাদেশের পাখি(ঢাকা:বাংলা একডেমী,২০০৮),রেজা খান ,প্রিস্টহা.৩৪৩-৪৪
২.বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রানী জ্ঞানকোষঃ পাখি, খন্ডঃ২৬ জিয়া উদ্দিন আহমেদ(সম্পাদক)(ঢাকাঃ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯)   পৃষ্ঠা-৬৭।
৩.লালমাথা কুচকুচি, ইনাম আল হক,তারিখঃ ২৬-০৮-২০১০,দৈনিক প্রথম আলো।